তুমি আজো রয়েছে হৃদয়ে

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী নায়ক সালমান শাহ’র ১৯তম শাহাদাত বার্ষিকী পালন করা হবে আগামী ৬ সেপ্টেম্বর। চোখের পলকে কেটে গেল ১৯টি বছর। তবুও ভক্তদের হৃদয়ে আজো অমলিন হয়ে বেঁচে রয়েছে এই প্রবাদ পুরুষ।

জন্ম:
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে সিলেট জেলায় অবস্থিত জকিগঞ্জ উপজেলায় সালমান শাহ জন্মগ্রহন। তার প্রকৃত নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। তাঁর পিতা কমর উদ্দিন চৌধুরী ও মাতা নীলা চৌধুরী। তিনি পরিবারের বড় ছেলে। যদিও তাঁর মুল নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন, কিন্তু চলচ্চিত্র জীবনে তিনি সবার কাছে ‘সালমান শাহ’ বলেই পরিচিত ছিলেন। সালমান শাহ ১২ আগস্ট ১৯৯২ বিয়ে করেন, এবং তাঁর স্ত্রীর নাম সামিরা।

১৯৯৩ সালে তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত কেয়ামত থেকে কেয়ামত মুক্তি পায়। একই ছবিতে নায়িকা মৌসুমী ও গায়ক আগুনের অভিষেক হয়। জনপ্রিয় এই নায়ক নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে সাড়া জাগানো অনেক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

সংক্ষিপ্ত জীবনী:
১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে হানিফ সংকেতের গ্রন্থনায় কথার কথা নামে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচারিত হত। এর কোন একটি পর্বে ‘নামটি ছিল তার অপূর্ব’ নামের একটি গানের মিউজিক ভিডিও পরিবেশিত হয়। হানিফের সংকেতের স্বকন্ঠে গাওয়া এই গান এবং মিউজিক ভিডিও দুটোই অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত। একজন সম্ভাবনাময় সদ্য তরুন তার পরিবারের নানারকমের ঝামেলার কারনে মাদকাসক্ত হয়ে মারা যায়, এই ছিল গানটার থিম। গানের প্রধান চরিত্র অপূর্বর ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমেই সালমান শাহ মিডিয়াতে প্রথম আলোচিত হন। তখন অবশ্য তিনি ইমন নামেই পরিচিত ছিলেন।

মিউজিক ভিডিওটি জনপ্রিয়তা পেলেও নিয়মিত টিভিতে না আসার কারনে দর্শক আস্তে আস্তে ইমনকে ভুলে যায়। আরও কয়েক বছর পর অবশ্য তিনি আব্দুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় পাথর সময় নাটকে একটি ছোট চরিত্রে এবং কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রেও কাজ করেছিলেন। ১৯৯৩ সালের ২৫শে মার্চ। ঈদুল ফিতর। হিন্দি কেয়ামত সে কেয়ামত তক ছবির কপিরাইট বৈধভাবে কিনে আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানকে দিয়ে তৈরী করে কেয়ামত থেকে কেয়ামত।

সেসময়কার জনপ্রিয় মডেল আনন্দবিচিত্রা সুন্দরী মৌসুমীর সাথে অভিনয় করেন অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিচিত ইমন। প্রযোজকগোষ্ঠি অবশ্য ততদিনে পারিবারিক নামকে একটু কাটছাট করে তার পর্দা নাম ঠিক করেছেন সালমান শাহ। খলনায়ক ডন (সাম্প্রতিক ছবি) নায়ক-নায়িকা ছাড়াও এই ছবিতে ডন নামের এক তরুন খলনায়কের অভিষেক ঘটে। বেশিরভাগ ছবিতে যেহেতু তরুন নায়কের কাউন্টার পার্ট হিসেবে একজন তরুন খলনায়কের প্রয়োজন হয়, সালমানের সাথে সাথে ডনের ক্যারিয়ারও দাঁড়িয়ে যায়। সালমান নিজেও ডনকে যথেষ্ট সহযোগিতা করে উপরে ওঠার সুযোগ করে দেন এবং তার প্রায় সব ছবিতেই ডনের উপস্থিতি ছিল। একসাথে প্রচুর কাজ করতে করতে ডন সালমানের পারিবারিক বন্ধু হয়ে ওঠে।

সালমান সম্বন্ধে শুধু এটুকু বলা যায়, বাংলাদেশি বাংলা ছবির প্রায় ৫০ বছরের ইতিহাসে সেই প্রাচীন আমলে রহমান এবং নায়করাজ রাজ্জাকের পর সালমানই একমাত্র নায়ক যিনি সর্বমহলে তার গ্রহনযোগ্যতা তৈরী করতে এবং তরুনদের স্টাইল আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। বাংলা ছবির নায়কদের মধ্যে সালমান ছাড়া অন্য কারো ফ্যাশন, স্টাইল লোকে তার আগে বা পরে কখনোই অনুসরন করেনি। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনী হয়ত অনভ্যাস, সিনেমা হলের পরিবেশ এবং তার অভিনীত ছবিগুলির মানের কারনে হলে যায়নি, কিন্তু নায়ক হিসেবে সালমানকে বরণ করে নিয়েছিল। (সালমান শাহ, শমী কায়সার, তমালিকা কর্মকার অভিনীত নাটক নয়ন (১৯৯৫) জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাবস্থায় তিনি বিটিভির নিজস্ব প্রডাকশন মামুনুর রশীদের ধারাবাহিক ইতিকথা এবং আরও কিছু প্যাকেজ নাটকেও অভিনয় করেন। বিটিভির নিজের নাটক, এমনকি প্যাকেজ নাটকের শিল্পীদেরও যে সামান্য পারিশ্রমিক সেটা সালমান কোন ছবির এক শিফটের কাজ করেও এর চেয়ে বেশি পেতেন। কিন্তু নিজের তারকা ইমেজকে তিনি বাংলা ছবির তথাকথিত নিয়মিত দর্শকদের মধ্যে সীমিত না রেখে সার্বজনীন জনপ্রিয়তা পেতে চেয়েছিলেন এবং একাজে তিনি দুর্দান্তভাবে সফল।

শিক্ষাজীবন:
সালমান শাহ খুলনা বয়রা মডেল হাইস্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে ধানমন্ডির আরব মিশন স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৮৭ সালে ধানিমন্ডির আরব মিশন স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি এবং মালেকা সায়েন্স কলেজ, ধানমন্ডি থেকে স্নাতক শেষ করেন।

অভিনয় জীবন:
১৯৯৩ সালের ঈদুল ফিতরের ছবিগুলোর মাঝে মুক্তি পায় সোহানুর রহমান সোহানের রেকর্ড পরিমান ব্যবসাসফল ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ । যা পরিচালক ও প্রযোজক ভারত থেকে মুল ছবির প্রযোজক ও পরিচাকের অনুমতি নিয়েই ছবিটি তৈরি করেন। সোহান তখন ইন্ডাস্ট্রির নবীন একজন পরিচালক যিনি বাংলাদেশের ৮০র দশক থেকে ৯০ দশক এর সবচেয়ে সেরা পরিচালক এ জে মিন্টুর সহকারী পরিচালক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন এবং মিন্টুকেই যিনি ‘গুরু’ মানেন। ৯২ সালে ‘বেনাম বাদশাহ’ দিয়ে সোহান পরিচালকের খাতায় নাম লিখান যেটি ছিল সেই সময়ের অন্যতম ব্যবসাসফল ছবি। প্রথম ছবিতেই সোহান বুঝিয়ে দিয়েছিলেন গুরু মিন্টুর যোগ্য একজন ছাত্রই ছিলেন তিনি। সোহানের ছবি দিয়ে কাজ শুরু করলেও সালমান কে কখনও গুরু এ জে মিন্টুর ছবিতে পাওয়া যায়নি। যা সালমান এর নিজেরও একটা আক্ষেপ ছিল মিন্টুর ছবিতে কাজ না করার জন্য।

এরপর তিনি ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রহস্যজনক ভাবে মৃত্যুবরণ করেন। অভিযোগ উঠে, তাকে হত্যা করা হয়; কিন্তু তার সিলিং ফ্যানে ফাঁসিতে হত্যাকান্ডের কোনো আইনী সুরাহা আজ পর্যন্ত হয়নি।

মাত্র তিনবছরের ক্যারিয়ারে প্রয়াত সালমান যে সকল খ্যাতিমান ও গুণী পরিচালকদের ছবিতে কাজ করেছিলেন তাদের নাম ও ছবির তালিকা – সোহানুর রহমান সোহান (কেয়ামত থেকে কেয়ামত), শিবলি সাদিক – (অন্তরে অন্তরে, আনন্দ অশ্রু ও মায়ের অধিকার), জহিরুল হক ( তুমি আমার ও সুজন সখী), গাজী মাজহারুল আনোয়ার (স্নেহ), শফি বিক্রম্পুরি ( দেনমোহর), দিলিপ সোম (মহামিলন), এম এম সরকার (চাওয়া থেকে পাওয়া, প্রেম পিয়াসি), বাদল খন্দকার ( স্বপ্নের পৃথিবী), হাফিজউদ্দিন ( আঞ্জুমান), দেলোয়ার জাহান ঝনটু ( কন্যাদান) , মালেক আফসারি ( এই ঘর এই সংসার), এম এ খালেক ( স্বপ্নের পৃথিবী), জীবন রহমান (প্রেমযুদ্ধ), মোহাম্মদ হান্নান (বিক্ষোভ), মোহাম্মদ হোসেন (প্রিয়জন), মতিন রহমান (তোমাকে চাই) ,শাহ আলম কিরন ( বিচার হবে), জাকির হোসেন রাজু ( জীবন সংসার) তমিজ উদ্দিন রিজভী (আশা ভালোবাসা) ।

বাংলা সিনেমাপ্রেমী দর্শক, ভক্তরা সালমানকে এতটাই ভালোবাসত যে, তার এমন অকাল মৃত্যুর শোক সহ্য করতে না পেরে সেই সময় অনেকেই আত্মহত্যাও করেছিলেন। যা বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিরল এক ঘটনার জন্ম দিয়েছে!

বাংলা সিনেমায় আধুনিকতা ও পরিবর্তন এসেছে সালমানের হাত ধরেই। বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পে নায়ক সালমান শাহ্’র অবদান অসামান্য, অথচ সালমানের মৃত্যুর এতগুলো বছর পার হওয়ার পরও আজ পর্যন্ত এই মহায়নাকের স্মরণে কিছুই করা হয়নি! শিল্পী সমিতির পক্ষ থেকে ইতি পূর্বে সালমানের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী পালন করার মত তেমন কোন উদ্যোগও নেওয়া হয়নি, শুনেছি মৃত শিল্পীদের নামের তালিকাতেওও নাকি সালমানের নামটির ঠাই হয়নি!
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর